বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের লাবণী সৈকত পয়েন্ট পর্যটকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নাম। এ পয়েন্টটির নামকরণ হয়েছে পর্যটন মোটেল লাবণীর নাম থেকে। পয়েন্টটির পূর্বে অনুমানিক ৩০০ মিটার দূরে অবস্থিত মোটেল লাবণী। প্রতিষ্ঠানটি গেইটের পশ্চিত ছোট্ট পরিসরের সাদামাঠা সাইজ বোর্ড ইস্টিশন।
খুব স্বাভাবিকভাবে পর্যটন স্পট ঘীরে ব্যবসার কথা বিবেচনা করে নানা প্রসাদনী, খাবার সহ ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও ইস্টিশন গতানুগতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরে একটি জগৎ। ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে নানা ভাঁজে সাজানো আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ নানা ধরনের বই। আছে বিখ্যাত ও বরেণ্য সব কবি সাহিত্যিকের কবিতা, গল্প, উপন্যাসও। বইয়ের পাশাপাশি নান্দনিক কারুকাজে টি-শার্ট, শোপিচসহ নানা ধরনের দেশীয় পণ্য সামগ্রীও রয়েছে এই বুক স্টলে।
প্রতিষ্ঠানটির সত্ত¡াধিকারী উন্নয়ন কর্মী অনুরণন সিফাত। একটি সংস্থায় চাকুরির পাশা-পাশি গত ৩ বছর আগে গড়ে তুলেন এ প্রতিষ্ঠান। তিনি জানান, ব্যবসায়িক কোন উদ্দেশ্যে নয়, সৃজনশীলতার বিকাশ, সৃষ্টিশীল মানুষের আনাগোনা বাড়ানো এবং মনের খোরাক মেটাতে এমন উদ্যোগ। এখানে পর্যটকরা ভ্রমণে এসে এক প্রবেশ করে ঘুরে দেখলেন, কিছু বই সম্পর্কে পরিচিত হলেন, সময় সুযোগ পেলে বসে বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা পড়লেন। এতেই তিনি আনন্দিত।
তিনি মনে করেন, সমুদ্র তীরে বইয়ের দোকান বাংলাদেশে সম্ভবত প্রথম। যা ভিন্ন একটি আমেজ তৈরি করেছে পর্যটন কেন্দ্রটিতে। উদ্যোক্তা জানান, তিনি এ প্রতিষ্ঠানটি আরও বেশি শানিত করবেন।
ইস্টিশনের যত আয়োজন :
এ কেবল একটি বুক স্টল না। এ প্রতিষ্ঠান ঘীরে বছর ব্যাপী চলে নানা আয়োজন। কক্সবাজারে ভ্রমনে আসা দেশ-বিদেশের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী গুনীজনদের ঘীরে কক্সবাজারে সৃজনশীল মানুষের আড্ডা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হচ্ছে বই ভিত্তিক পাঠ ও আলোচনা। গান চর্চা, পিঠা উৎসব, বই উৎসবের আয়োজনও হয়েছে। পাঠচক্র, সাহিত্য আড্ডা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, বিজয় উৎসব, বৈশাখ এবং বসন্ত সমাগম এরকম নানা আয়োজনে শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চা বিকাশে ভূমিকা রাখছে ইস্টিশন। সম্প্রতি গত ২৭ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ দিনের সমুদ্র বই উৎসবও শেষ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি উদ্যোগে। সৈকতের কিনারে লাবণী পয়েন্টের বালিয়াড়িতে আয়োজিত বই উৎসবে অংশ নিয়েছে দেশের ১০ টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানটি এসে আড্ডা দিয়েছেন কবি আসাদ মান্নান, কালি ও কলম সাহিত্য পুরষ্কার প্রাপ্ত সাকিরা পারভিন সুমা, জেমকন সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত মুম রহমান, আমা দাবলাম জয়ী প্রথম বাংলাদেশি অভিযাত্রী, পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা ভ্রমণকারী একমাত্র বাংলাদেশী বাবর আলী সহ অনেক গুণীজন।
অনুরণন সিফাত জানান, ছাত্রছাত্রীদের মননের বিকাশ ইস্টিশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তাই শিশু-কিশোরদের জন্য স্কুল ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে ইস্টিশন। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা ইত্যাদি সে কার্যক্রমেরই অংশ। গত ২৬ জানুয়ারি কক্সবাজার শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধ ‘ ক্যাটাগরিতে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা। কক্সবাজারের ৬ টি বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এছাড়াও ১৬ জানুয়ারি রামু উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘বিজয়’ এবং ‘আমাদের গ্রাম’ এ দুটি ক্যাটাগরিতে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ রকম সৃষ্টিশীল আরও আয়োজনের চিন্তা রয়েছে তার।
ইস্টিশনকে পর্যটন কেন্দ্র নতুনভাবে উপস্থাপনার প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন পর্যটন ব্যবসায়ী ও ট্যুর গাইড বেলাল আবেদীন। তিনি জানান, পর্যটককে ভ্রমনে আসেন আনন্দ উপভোগের জন্য। এখানে সমুদ্র কিনারে বই নিশ্চিত জ্ঞান বিকাশের ভিন্ন আনন্দ পাওয়া যাবে।
কবি মানিক বৈরাগী জানান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমুদ্র সৈকত কেন্দ্রিক বই পড়ুয়াদের জন্য বিশাল আকার নিয়ে লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে বহুকাল আগে থেকেই। এসব উদ্যোগ সরকারি বেসরকারি অনেক ক্ষেত্রে যৌথভাবে গড়ে উঠেছে। এমন কি এশিয়ায় আমাদের পাশের দেশ ভারতেও সমুদ্র সৈকত কেন্দ্রিক বইয়ের দোকান ও গণপাঠাগার আছে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের পাশে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে অনুরণন সিফাত বিশ্ব ঐতিহ্যের সাথে বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রাথমিক পর্যায়ে ছোট আকারে হলেও একটি শুধু সৃজনশীল-মননশীল বইয়ের দোকান ইস্টিশনের অভিযাত্রা কক্সবাজার তথা বাংলাদেশের সাথে বিশ্ব পাঠকের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। ইস্টিশন এ বছর সৈকতে যে সমুদ্র বই উৎসবের যাত্রা শুরু করেছে তাও বাংলাদেশের প্রথম। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শুভ কামনা জানান তিনি।
কবি গবেষক আলম তৌহিদ জানান, জ্ঞানার্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বই। বই কেবল মনের খোরাক নয়, টনিকও। সমুদ্রের জলধ্বনির কাছাকাছি ‘ইস্টিশন’ মূলত সেই বই নামক টনিকের অভিজাত বিপণি। পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণে ‘ইস্টিশন’-এর ইপ্সিত অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক।