নিরবেই চলছে সমুদ্র পথে মানব পাচার

তারেকুর রহমান (১৫), মাতৃহীন বেকার কিশোর। মা মারা যাওয়ায় পিতা ছৈয়দ নুর দ্বিতীয় বিবাহ করে নিরুদ্দেশ। অতি কষ্টের মধ্যে স্নেহ আদর বঞ্চিত এ কিশোর গত মাসাধিক সময় ধরে নিখোঁজ রয়েছে। সম্প্রতি সাগর পথে মালয়েশিয়াগামী বোটে করে ঐ কিশোর মানব পাচারকারী চক্রের হেফাজতে সমুদ্রে রয়েছে বলে দালাল চক্র সংবাদ দিয়ে মোটা অংকের অর্থ দাবী করে আসছে। মানব পাচার চক্রের হাতে জিম্মি থাকা কিশোর তারেকের বাড়ী উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের পশ্চিম ফারির বিল গ্রামে।

শুধু কিশোর তারেক নয়, এর সাথে আরো কয়েকজনকে ফুসলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র পথে মালয়েশিয়াগামী ইঞ্জিন বোটে তোলে দেয় মানব পাচারকারী চক্র। এধরনের নিখোঁজ উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের একই গ্রামের মিজানুর রহমান নামের আরো এক যুবককে গভীর সমুদ্রে মানব পাচারকারী চক্র জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এভাবে এক প্রকার নিরবেই সমুদ্র পথে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে মানব পাচার তৎপরতা।
অভিযোগে জানা যায়, গত ৩ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ হন উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের পশ্চিম ফারিরবিল গ্রামের হত দরিদ্র আয়ুবুল ইসলামের ছেলে মিজানুর রহমান (২৬) ও প্রতিনিধিত্বের ছৈয়দ নুরের ছেলে তারেকুর রহমান (১৫)। বেশ কয়েকদিন খোঁজাখুঁজি করেও তাদের সন্ধান না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে আত্মীয় স্বজনরা।
নিখোঁজের ৮/১০ দিন পর স্হানীয় একই গ্রামের আলী হোসেনের দুই ছেলে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য ছৈয়দুল বশর ও মোঃ দেলোয়ার এবং শফি উল্লাহর ছেলে মোঃ জাকির নিখোঁজ দুইজনকে তারা সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করেন বলে জানা গেছে। গত ৫ নভেম্বর উখিয়া থানায় এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের পশ্চিম ফারিরবিল গ্রামের মৌলভী নুরুল আলম।

মৌলভী নুরুল আলম জানান, সম্প্রতি স্হানীয় উক্ত চিহ্নিত মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা পাচারের শিকার মিজানুর রহমানের স্ত্রী মনিরা বেগম ও এতিম কিশোর তারেকের দাদা মির কাশেমের নিকট দুইজনকে ভালভাবে মালয়েশিয়া পৌঁছে দিতে ৯ লক্ষ টাকা দাবী করে। অন্যথায় মিজান ও তারেককে গভীর সমুদ্রে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয় বলে জানা যায়।
মৌলভী নুরুল আলম জানান, পাচারের শিকার হওয়া অতি দরিদ্র মিজান তার ভাতিজা হয় এবং তারেক সম্পর্কীয় নাতি হয়। দালাল চক্র গ্রামের সহজ সরল বেকার কিশোর – যুবকদের টার্গেট করে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রলোভনে ফেলে ফতুর করছে।
চলতি শীত মৌসুমে সমুদ্র অনেকটা শান্ত থাকায় সাগর পথে চরম ঝুঁকি নিয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশী কিছু মানুষও পাচারের শিকার হচ্ছে। তবে সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে পাচারের শিকার ভিকটিমের মধ্যে ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা বলে জানা যায়। বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পে নানা অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতায় অধিকাংশ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। আগে শীত মৌসুমে সমুদ্রের শান্ত পরিবেশে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া গামী হলেও গত বছর থেকে সারা বছরই মানব পাচার চলে আসছে বলে জানা যায়।
অনুসন্ধানে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা জানান, সমুদ্র পথের পাশাপাশি মিয়ানমার হয়ে সড়ক পথে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড পাচার হয়ে যাচ্ছে। আগে থেকে মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান। তাদের মধ্যে মোটামুটি সচ্ছল রোহিঙ্গারা তাদের স্বজনদের দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্প ও রাখাইন থেকে প্রথমে সমুদ্র ও মিয়ানমারের স্থল পথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড নিয়ে যায়। সেখান থেকে কৌশলে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মাধ্যমে রিফুউজি কার্ড করে। অনেকে টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়ার পাসপোর্ট বানিয়ে নেয়।
মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড হতে বাংলাদেশ ও রাখাইন থেকে পাচারের বছরের মধ্যে এসব রোহিঙ্গাদের উল্লেখিত দেশসহ ইউরোপের রাস্ট্রগুলোতে কৌশলে মাইগ্রেশন করিয়ে নিয়ে যায় বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। তবে পাচারকৃত অধিকাংশ রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় থেকে যায়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বৈধভাবে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে এসব রোহিঙ্গারা পুরনো ও নতুন সৃষ্ট দালালের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মালয়েশিয়ান মুদ্রা রিংগিতের মান বৃদ্ধি হওয়ায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া গামী রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু বাংলাদেশী সাড়ে পাঁচ হতে ছয় লক্ষ টাকা খরচ পড়ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র আরো জানান, ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারী সামরিক জান্তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা পুষ্ট দালালরা অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে বর্তমান সামরিক জান্তা বিরোধী মিয়ানমার জুড়ে একটা অবস্থান তৈরী হয়েছে। সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ঘাটে ঘাটে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, বর্ডার গার্ড ও বিভিন্ন প্রদেশে অঞ্চল ভিত্তিক সক্রিয় বিদ্রোহীদের হাতে নিয়ে মিয়ানমারকেই মানব পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে বেচে নিয়েছে দালাল চক্র।
এধরনের পথে পাচার কালে সামরিক বাহিনী, বর্ডার গার্ড ও বিভিন্ন বিদ্রোহীদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার গরমিল হলেই রোহিঙ্গারা আটক হচ্ছে বলে জানা যায়। গত কয়েক মাসে এ ধরনের পাচার কালে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করার খবর পাওয়া গেছে। রাখাইন থেকে সিলকৃত লরি করে পাচারকালে ধম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া ১৩ রোহিঙ্গা যুবকের মৃতদেহ মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন অঞ্চলের রাস্তার পাশে ফেলে দেয়া হয়।
গত সপ্তাহে ইয়াঙ্গুন অঞ্চলে অন্তত দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী পুরুষকে আটকের খবর পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবরে প্রকাশ গত তিনদিন ধরে থাইল্যান্ড উপকূলে রোহিঙ্গা বোঝাই দুটি ফিশিং বোট আটকা পড়েছে। একই ভাবে পাচারকৃত রোহিঙ্গা বোঝাই আরো কয়েকটি বোট আন্দামান সাগরে ভাসছে বলে জানা যায়।
উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, অধিকাংশ মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে পাচারকারী ও ভিকটিমদের মধ্যে বোঝাপড়ায়। কোন কোন ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হলে কিছু অভিযোগ থানায় আসে। এক্ষেত্রে পুলিশ বা সংশ্লিষ্টদের কিছু করার থাকে না। এরপরও মানব পাচার সংক্রান্ত কোন অভিযোগ পেলে পুলিশ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে ওসি জানান।

Leave a Reply