মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় পড়া চলছে। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আজ সোমবার দুপুরে ৩০০ পৃষ্ঠার এ রায় পড়া শুরু করেন। রায় শুনতে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে রয়েছেন কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামি। এই ১৫ আসামিকে দুপুর ২টার দিকে কড়া পুলিশি পাহারায় আদালতে হাজির করা হয়।
এদিকে, রায়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আসামি ওসি প্রদীপ ও টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে কথা বলতে দেখা গেছে। ওসি প্রদীপ জিন্স ও ছাই রঙের জাম্পার এবং লিয়াকত নীল রঙের জিন্স, সাদা-লাল রঙের টিশার্টসহ সাদা-কালো জ্যাকেট পরে রয়েছেন।
রায়ের প্রথম দিকে বাকি ১৩ আসামিকে কাঠগড়ার উত্তর পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। যদিও এখন সব আসামি নিরব হয়ে বসে থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন।
রায় পড়ার শুরুতে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘রায় লিখতে আমি একটি তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছি। তা হলো চেকপোস্টে উপপরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী প্রথমে মেজর সিনহার পরিচয় পেয়ে স্যালুট দিল এবং চলে যেতে বলল। এরপরও কেন হত্যাকাণ্ড ঘটল?’ বিচারক আরও বলেন, ‘এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, না-কি অন্য কিছু!’
৩০০ পৃষ্ঠার রায় পড়ার শুরুতে বিচারক বলেন, “আমি উভয়পক্ষের আইনজীবীদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাই। আইনজীবীদের কাছে জানার পরে আসামি শাহজাহান আলীকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেন, ‘আসামি রাজীব মেজর (অব.) সিনহার পরিচয় পেয়ে স্যালুট দেয়। আমিও স্যালুট দিয়ে চলে যেতে বলি। কিন্তু চেকপোস্টের পেছনে বটগাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে ছিল পরিদর্শক লিয়াকত। সে কেন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল? তা আমরা জানতাম না। মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যে লিয়াকত আলী দৌড়ে এসে থামিয়ে গুলি করে দেয়। এ কারণে আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।’”
বিচারক ইসমাইল হোসেন আরও বলেন, ‘যদি ওই সময় সিনহার পরিচয় পাওয়ার পর হত্যাকাণ্ড আটকানো যেত, তাহলে আজ এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।’ এ সময় বিচারক আরও বলেন, ‘রায় ৩০০ পৃষ্ঠার। আমি পুরো রায় পড়ব।’
এদিকে, আজ সকাল থেকে রায়কে কেন্দ্র করে কক্সবাজার জেলা আদালত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। আদালতের ফটকসহ সবদিকে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-অপারেশন) সেলিম উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আদালতের চারপাশে কঠোর নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ও তিনটি সংস্থার সমন্বয়ে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে গুলিতে নৃশংসভাবে খুন হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। অন্যদিকে, বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত বলেছেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে বাদীপক্ষ।’ তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
এ মামলার ১৫ আসামি হলেন—টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী (৩১), টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ (৪৮), বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত (৩০), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩), আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)।
মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র্যাুব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৬৫ জন ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য দেন।