অর্থ সংকটে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণায় রোহিঙ্গাদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নিপীড়িত এ সম্প্রদায়ের নেতারা বলেছেন, এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে। মানব পাচারের আশঙ্কা জোরালো হবে।
শুক্রবার রোহিঙ্গা শিবিরের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টি জানায় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। বর্তমানে এ কর্মসূচি থেকে রোহিঙ্গারা প্রতি মাসে মাথাপিছু ১২ ডলারের খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। আসন্ন মার্চ থেকে ২ ডলার বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হবে।
রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে এ ঘোষণায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এ বিষয়ে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা নূর বশর বলেন, সহায়তা কমিয়ে দিলে আমাদের জীবনযাত্রার ওপর খুব বাজে প্রভাব পড়বে। কারণ, বাইরে কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় দুঃখকষ্টে জীবন চালাতে হয়। এখন তা আরও তীব্র হবে। এতে রোহিঙ্গাদের অভাব আরও বেড়ে যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, লোকজন অভাবে থাকলে বিভিন্ন অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ সিদ্ধান্তের ফলে শরণার্থী শিবিরে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির
অবনতির আশঙ্কা এবং অপুষ্টিজনিত সংকট বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, খাদ্য সহায়তা কমিয়ে আনলে শরণার্থী শিবিরগুলোতে আরও সহিংসতা এবং অস্থিরতা বাড়তে পারে। আরও বেশি বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় ঝুঁকি তৈরি হবে।
ডব্লিউএফপির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নতুন করে অর্থ সহায়তা না পেলে এই রেশন আগামী এপ্রিল থেকে আরও কমানো হতে পারে। এ পরিস্থিতি এড়াতে দাতাদের কাছে সাড়ে ১২ কোটি ডলারের জরুরি তহবিল চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, সহায়তা কমানোর প্রভাব অবশ্যই রয়েছে। তিনি বলেন, খাদ্যের অভাব থাকলে রোহিঙ্গারা কাজের সুযোগ খুঁজতে ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবে। এতে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকবে।
জানতে চাইলে টেকনাফ লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে খাদ্যসামগ্রী ছাড়াও জামাকাপড়সহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে রোহিঙ্গারা হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় বরাদ্দ কমে গেলে রোহিঙ্গাদের পাচার কিংবা সমুদ্রপথে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে।
রোহিঙ্গা সংকটের প্রায় ছয় বছরের মাথায় এই প্রথমবারের মতো ডব্লিউএফপি জীবন রক্ষাকারী সহায়তা কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে। ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত।
রোহিঙ্গারা তাঁদের খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন মেটাতে মানবিক সহায়তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। মানবিক সহায়তা দানকারী সংস্থাগুলোর সমবেত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খেতে পারে না। শিবিরে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো শিশুর সঠিক শারীরিক বিকাশ ও বৃদ্ধি হয় না। অন্তঃসত্ত্বা ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন- এমন নারীদের ৪০ শতাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।
ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা সাইদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি যে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ কমছে। কিন্তু ডব্লিউএফপির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত শিবিরগুলোতে মানবিক সংকটের পথ প্রশস্ত করবে।’
সুশীল সমাজের আরেক নেতা সলিমুল্লাহ বলেন, রেশন কমানো হলে শিবিরে অপরাধ বাড়বে, নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি একটি বিধ্বংসী আঘাত হবে। সন্ত্রাস, মাদক ও মানব পাচার বৃদ্ধি পাবে। সেভ দ্য চিলড্রেনের অন্নো ভ্যান মানেন এক বিবৃতিতে বলেন, রোহিঙ্গা শিশু এবং তাদের পরিবারগুলোর আরও বেশি সহায়তা প্রয়োজন, কম নয়।