রামুতে কল্পজাহাজ ভাসানোর উৎসব ঘিরে মিলনমেলা

হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী:

বাঁশ, বেত ও রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি ‘স্বর্গের জাহাজ’। বাঁকখালী নদীতে ভাসানো হলো সেই জাহাজ। একে একে নয়টি। এ সময় বেজে উঠল বাদ্যযন্ত্র। নাচগানে মেতে উঠলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার বাঁকখালী নদীর দ্বীপ শ্রীকুল পয়েন্টে সোমবার (১০ অক্টোবর) ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবে যোগ দেয় অন্তত ১০ হাজার মানুষ। উপজেলার হাইটুপি, দ্বীপ শ্রীকুল, হাজারীকুল, রাখাইনপাড়া, দক্ষিণ শ্রীকুল, পূর্ব রাজারকুল জাদিপাড়া, মেরংলোয়াসহ অন্তত ২৪টি গ্রামের মানুষ যোগ দেয় এই জাহাজ ভাসানোর উৎসবে।

পাঁচ-ছয়টি নৌকাকে একসঙ্গে বেঁধে তার ওপর বসানো হয় জাহাজ। জাহাজে বাঁধা মাইকে বাজে বুদ্ধকীর্তন। এর সুরে ভাসতে ভাসতে জাহাজগুলো ছুটছিল নদীর এদিক–সেদিক।

জাহাজ ভাসানো উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন- প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি বলেন- ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পর রামুতে সম্প্রীতি ফিরে এসেছে। আজকের সম্প্রীতির জাহাজ ভাসানোর এ অনুষ্ঠান তার প্রমাণ।

স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের সভাপতিত্বে ও জাহাজ ভাষা উৎসব উদযাপন পরিষদ-২২ এর সভাপতি অর্পন বড়ুয়ার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে বক্তব্য দেন- বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ব্যারিস্টার প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া, সিনিয়র সাংবাদিক নাজনীন মুন্নি, কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম সাদ্দাম হোসাইন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা মুস্তফা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া, বৌদ্ধধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া, রামু প্রেসক্লাব সভাপতি ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক তপন মল্লীক প্রমূখ।

উৎসব সম্পর্কে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহনঘা এলাকায় একটি নদীতে সংঘরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এই উৎসব প্রচলন হয়। রামু ছাড়া দেশের কোথাও এভাবে জাহাজ ভাসানো উৎসব হয় না।

বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জানান, আড়াই হাজার বছর আগে বৈশালী রাজ্যে অনাবৃষ্টি, খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর প্রভাবে মানুষ ও জীবজন্তু মারা যাচ্ছিল। তখন গৌতম বুদ্ধ বৈশালী রাজার আমন্ত্রণে শিষ্যদের নিয়ে ওই রাজ্যে যান। তিনি ‘রত্নসূত্র’ পাঠ করে খারাপ দেবতার প্রভাব থেকে বৈশালীকে রক্ষা করেন। ফিরতি পথে সর্পদেবতারা ৫০০টি নৌকায় শিষ্যসহ বুদ্ধকে নদী পার করে দেন। সেই দিনকে স্মরণ করতেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ জাহাজ ভাসানো উৎসব পালন করে আসছে। প্রতিবছর তিন মাস ভিক্ষুদের বর্ষাব্রত পালন শেষে প্রবারণা পূর্ণিমার পরের দিন জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করা হয়।

জাহাজ ভাষা উৎসব উদযাপন পরিষদ-২২ এর সাধারণ সম্পাদক জিৎময় বড়ুয়া জানান- উৎসবের কিছুদিন আগে থেকে ঢোল, মন্দিরা, বাঁশিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বৌদ্ধকীর্তন গেয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা সংগ্রহ করে শিশু কিশোর ও যুবকেরা। সেই টাকায় তৈরি হয় বিভিন্ন প্রতিকৃতির একাধিক স্বর্গের জাহাজ।

কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি এস এম সাদ্দাম হোসাইন বলেন, রামুর বৌদ্ধপল্লিতে দ্বিতীয়বার হামলার সাহস কারও নেই। জাহাজ ভাসানো উৎসবে বিপুল বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকের উপস্থিতি প্রমাণ করে, রামু এখন শান্তি ও সম্প্রীতির শহর।

ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিক নাজনীন মুন্নি বলেন, ‘উৎসবে না এলে বুঝতে পারতাম না এ উৎসব কতটা বৈচিত্র্যপূর্ণ।

Leave a Reply